অভিমানে চাকরি থেকে নিজে অব্যাহতি নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) থেকে চাকরিচ্যুত কনস্টেবল শওকত হোসেন।
বৃহস্পতিবার (২৭ এপ্রিল) বিকেলে জানতে চাইলে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে আমি নিজে দরখাস্ত দিয়েছি। বুঝেনই তো আমার পোস্ট ছোট, কিন্তু কাজ বেশি। অনেক সময় আমাকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসতে হয়। আমি টিভিতে কথা বলি, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বলেন। বিষয়টি নিয়ে ঈর্ষান্বিত ছিলেন ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তা। তারা বিষয়টি মেনে নেননি। যদিও পুলিশে এক ধরনের শ্রেণি বৈষম্য ছিল এবং আছে। সবমিলিয়ে আমার সঙ্গে যাচ্ছে না, আমি নিজেও পারছি না। আমার মানবিক কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ জন্য এক ধরনের অভিমান নিয়ে আমি নিজেকে গুটিয়ে নিলাম।’
তিনি বলেন, ‘আগে আমাকে শুধু মানবিক কাজ করার জন্য সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আমার সঙ্গে হিংসাত্মক আচরণ শুরু হয়। বিভিন্ন জায়গায় পোস্টিং করা হয়। এতে আমার ভালো কাজের ব্যাঘাত ঘটে। তারা আমাকে অনেকটা মানবিক কাজে নিরুৎসাহিত করে।’
চাকরিচ্যুতির পর নিজের পরিকল্পনার বিষয়ে শওকত বলেন, ‘আমার মানবিক কাজ চলমান আছে। এখন আমি চাকরি থেকে অব্যাহতি নেওয়ায় আরও জোরালো হবে। এখন আমরা একটা বেওয়ারিশ হাসপাতাল করব। চাকরির জন্য যেটি করতে পারিনি। আমি নিজে কোনো প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করব।’
চাকরিচ্যুতির বিষয়ে শওকত হোসেন বলেন, ‘আমাকে মানবিক ইউনিট থেকে সরিয়ে একবার পোস্টিং করা হলো কর্ণফুলী থানায়, আরেকবার কুমিল্লায় পোস্টিং করা হলো। আমি চাকরি থেকে অব্যাহতি নেওয়ার জন্য তিনবার আবেদন করেছি। দুটি সিএমপি কমিশনার বরাবর ও একটি কুমিল্লা পুলিশ সুপার বরাবর। কিন্তু তারা সময়ক্ষেপণ করে আমার দরখাস্ত গ্রহণ করেননি। একপর্যায়ে আমি নিজে থেকে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। পরবর্তীতে তারা আমাকে চাকরিচ্যুত করে।’
তিনি বলেন, ‘একটা সময় ছিল যখন মানবিক ইউনিট নামে একটা বিশাল ইউনিট ছিল। এই ইউনিটের মাধ্যমে পুলিশ বেওয়ারিশ লোকজনের সেবা করতে থাকে। পুলিশ শুধু বড় লোকের না, তারা গরীব-অসহায় লোকজনের সেবা করে, এই ইউনিটের মাধ্যমে বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়।’
এর আগে, গত ১৬ এপ্রিল সিএমপি বন্দর জোনে কর্মরত কনস্টেবল শওকতকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তবে বিষয়টি জানাজানি হয় বৃহস্পতিবার (২৭ এপ্রিল)।
এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে ডিসি শাকিলা সোলতানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, কনস্টেবল হোক বা এসপি হোক, কেউ যদি অসুস্থতা কিংবা কোনো ধরনের কারণ দর্শানো ছাড়া দীর্ঘদিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন, তখন তাকে নিয়মানুযায়ী শোকজ করা হয়। শওকত টানা ৭১ দিন কর্মস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। এ কারণে তাকে শোকজ করা হয়। তবে শওকত শোকজের কোনো জবাব না দেওয়ায় তার নামে বিভাগীয় মামলা রুজু হয়। তারপরও তিনি উপস্থিত হননি। এ কারণে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, চাকরিচ্যুতির জন্য সুপারিশ আদেশের পর তার কাছে এটা অপমানজনক মনে হয়েছে। এ কারণে তিনি নিজে থেকে অব্যাহতির জন্য আবেদন করেছেন। যদিও পরবর্তীতে এটি বিবেচনার সুযোগ ছিল না। তিনি আগে থেকে অব্যাহতির আবেদন করলে সেটি বিবেচনা করে দেখা যেত।
শওকতকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আদেশে উল্লেখ করা হয়, ৭১ দিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়া অভিযুক্ত (শওকত হোসেন) শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সমস্যা থাকায় এবং বেওয়ারিশ মানুষ নিয়ে মানবিক কার্যক্রমে ব্যস্ত থাকায় পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি করা তার পক্ষে সম্ভব নয় এমন বক্তব্য লিখিতভাবে কর্তৃপক্ষকে জানানোর পর তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
জানা গেছে, অসহায় রোগীদের নানা সময়ে সেবার ব্যবস্থা করে প্রশংসিত হয়েছিলেন কনস্টেবল শওকত। দীর্ঘদিন নীরবে কাজ করলেও ২০১৯ সালে ২৯ নভেম্বর নগর পুলিশের মাসিক কল্যাণ সভায় তার বিষয়টি তৎকালীন সিএমপি কমিশনার মাহবুবর রহমানের সুনজরে আসে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি শওকতের নেতৃত্বে একটি ‘মানবিক পুলিশ ইউনিট’ চালু করেন।
তবে ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি নগরের দেওয়ানহাট এলাকায় একটি ওয়াজ মাহফিলে দেওয়া ‘বিতর্কিত’ বক্তব্যের জেরে তাকে ‘মানবিক পুলিশ ইউনিট’ সরিয়ে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তৎকালীন সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর মানবিক পুলিশ ইউনিট বিলুপ্ত করে দেন।
কারণ হিসেবে ওই সময় তিনি বলেছিলেন, আমদের সব পুলিশই মানবিক। আলাদা করে মানবিক ইউনিট রাখছি না। কারণ এখানে যেসব মেম্বার আছে বেশিরভাগই হাসপাতালের সদস্য। তারা তো এমনিতেই কাজ করছে। যে কারণে মানবিক ইউনিট করা হয়েছিল, পরিস্থিতি তার থেকে অনেক উন্নতি হয়েছে। এখন মানবিক কাজ করার জন্য সবাইকে দায়িত্ব দিয়েছি। সবাইকে বলেছি মানবিক বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে। আলাদা করে গ্রুপের প্রয়োজন নেই। সবাই তো অমানবিক না। সবাইকে মানবিক কাজ করতে বলা হয়েছে।
সিএমপি সূত্রে জানা গেছে, রাস্তায় স্বজনহীন কোনো মানুষ পড়ে থাকার খবর পেলেই ছুটে যেতেন এই ইউনিটের সদস্যরা। তাদের খাওয়া-দাওয়াসহ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন। ইউনিট গঠনের আগে থেকেই রাস্তায় স্বজনহীন অসহায় কিংবা মানসিক রোগী যাদের হাসপাতালে স্থান পেত না সেসব রোগীদের নিজেদের টাকায় সেবা দিয়ে আসছিলেন চট্টগ্রাম নগর পুলিশের কিছু সদস্য। আর তাদের নেতৃত্বে ছিলেন কনস্টেবল শওকত।