এসএম রুবেল ক্রাইম রিপোর্টার চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে।।
আজ ১৯শে এপ্রিল। গেল বছরের এইদিনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় শিবগঞ্জ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর ও সাবেক যুবলীগ নেতা খাইরুল আলম জেমকে। তার বাড়ি শিবগঞ্জ পৌরসভার মর্দানা গ্রামে। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে বসবাস করতেন। নিহত জেম সদর আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল ওদুদের ঘনিষ্ঠ অনুসারীও ছিলেন। এ ঘটনায় ওই বছরের ২২শে এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মোখলেসুর রহমানকে প্রধান আসামি করে ৪৮ জনের নামে হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহত জেমের ভাই মনিরুল ইসলাম। সে সময় জেম হত্যার বিচার দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে চাঁপাইনবাবগঞ্জ।এরপর গ্রেপ্তার হন হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দেয়া কৃষকলীগ নেতা মেসবাহুল হক টুটুলসহ তার সহযোগীরা। উদ্ধার করা হয় হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হাতুড়িও। প্রথমে কেউ বিশ্বাস করতে পারেনি এতো দ্রুত গ্রেপ্তার হবে তারা। স্থানীয়দের ধারণা ছিল- পুলিশ এদের গ্রেপ্তার করবে না।
এর আগেও তারা ককটেলবাজি, চাঁদাবাজি,মারপিটের মতো গুরুতর অপরাধ করেও পার পেয়ে যায়। প্রকাশ্যে দাপিয়ে বেড়িয়েছে পুরো চাঁপাইনবাবগঞ্জ। পাশাপাশি পুলিশও এই চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের সমীহ করতো। এমনকি এক বছরেও এ মামলার চার্জশিট দিতে পারেনি থানা পুলিশ। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী আছে, আসামিরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। তারপরও মামলাটি গত সপ্তাহে সিআইডিতে বদলি করা হয়েছে। স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন, আলোচিত টুটুল বাহিনীর পতনের পর থেকে শান্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জ। ককটেলবাজি আর দেশি অস্ত্রের মহড়া নেই। মানুষ এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছেন। যুবলীগ নেতা জেম কিলিং মিশনের নেতৃত্ব দেয়া টুটুল হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া ৫ আসামি এখনও কারাগারে। অন্য আসামিরা জামিনে আছেন। এই এক বছরে রাজনীতির দৃশ্যপট বদলে গেছে। হত্যা মামলার প্রধান আসামি হয়ে মাঠের রাজনীতিতে আধিপত্য হারিয়ে ফেলেন মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মোখলেসুর রহমান। অপরদিকে রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে ছিটকে পড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল ওদুদের আধিপত্য আরও পোক্ত হয়েছে।স্থানীয়রা বলছেন,গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল এমপি বনাম মেয়রের দ্বন্দ্ব। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী মোখলেসুর রহমান দাপট দেখিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। মেয়রের চেয়ারে বসার পর থেকেই তাকে ঘিরে শুরু হয় বিতর্ক। অল্প সময়ের ব্যবধানে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নেন মেয়র মোখলেসুর রহমান। তার সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের অধিকাংশ নেতা ছিলেন। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য আব্দুল ওদুদের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেন পৌর মেয়র।
তবে শিবগঞ্জ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর ও সাবেক যুবলীগ নেতা খাইরুল আলম জেম হত্যার পর হঠাৎই বদলে যায় দৃশ্যপট। রাজনীতির একক নিয়ন্ত্রণ চলে যায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওদুদের হাতে। দলটির নেতারা বলছেন, একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন আব্দুল ওদুদ। জেম হত্যার পর রাজনীতির ট্রামকার্ড পেয়ে যান তিনি। জেলার রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ এখন সংসদ সদস্য আব্দুল ওদুদের হাতেই।অভিযোগ রয়েছে- প্রতিপক্ষকে দমন করতে নিরপরাধ মানুষকেও হত্যা মামলার আসামি করিয়েছেন এমপি ওদুদ। আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি,পুলিশের তদন্ত ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী ১০/১৩ জনই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত। তবে আসামি করা হয়েছে ৪৮ জনকে। যারা আব্দুল ওদুদের বিপক্ষে রাজনীতি করতেন। এমনি মেয়রের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা ব্যক্তিরাও এ হত্যা মামলার আসামি হয়েছেন।তবে,এখন একেএকে সবাই ভিড়ছেন এমপি আব্দুল ওদুদের বন্দরে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আব্দুল ওদুদের নির্বাচনী পথসভায় দেখা যায় জেম হত্যা মামলার আসামি চরবাগডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান শাহিদ রানা টিপুকে। নির্বাচিত হওয়ার পর জেম হত্যা মামলার দুই নম্বর আসামি জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি সামিউল হক লিটনকে দেখা যায় এমপি ওদুদের সঙ্গে। সমপ্রতি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধনে তার সঙ্গে দেখা যাচ্ছে হত্যা মামলার প্রধান আসামি মেয়রকেও। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মোখলেসুর রহমান বলেন, রাজনীতিতে মামলার আসামি হওয়া নতুন ঘটনা নয়। আমি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছি। রাজনীতির মাঠে এমপি (আব্দুল ওদুদ) আমাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতেন। বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠন নিয়ে তার সঙ্গে আমার বিরোধ ছিল। নিহত খাইরুল আলম জেম আব্দুল ওদুদ এমপি’র অনুসারী ছিলেন। এ কারণে আমি এ মামলার প্রধান আসামি। মামলাটি তদন্ত চলছে, এ নিয়ে বেশিকিছু বলার নেই। তবে এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে আমরা একসঙ্গে কাজ করছি।
এ বিষয়ে সংসদ সদস্য আব্দুল ওদুদ বলেন, একজন আওয়ামী লীগের কর্মীকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে। যারা মেরেছে তারা তো মাদকাসক্ত ও এলাকার চিহ্নিত অপরাধী। স্বাভাবিক কারণে ধারণা করা হয় এদের পেছনে ইন্ধনদাতা আছে। তারা কারা? সেটি সামনে আসা উচিত। খুনিদের বিরুদ্ধ চার্জশিট দিতে পুলিশ টালবাহানা করবে এটা প্রত্যাশিত নয়। জেম হত্যা মামলার অন্যতম আসামি টুটুল ও তার সহযোগীরা আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যার হুকুমদাতার নাম উল্লেখ করেছে। সেখানে পরিষ্কার করে তারা বলেছে মেয়র মোখলেসুর রহমানের নির্দেশে তারা জেমকে হত্যা করেছে। এদের পেছনে রয়েছে পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা। যার কারণে হত্যা মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।তিনি আরও বলেন, একজন আওয়ামী লীগের নিবেদিত কর্মীকে প্রকাশ্যে হত্যার বিচার কার্যক্রম একজন পুলিশ কর্মকতার জন্য বাধাগ্রস্ত হবে সেটি মানা যায় না। এর জন্য আমাকে পদত্যাগ করতে হলেও আমি সবসময় মানসিকভাবে প্রস্তুত। মেয়র মোখলেসুর রহমানের সঙ্গে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন প্রসঙ্গে এমপি বলেন,হত্যা মামলার আসামী হলেও তিনি এখনো পৌরসভার মেয়র। আমি পৌরসভার উন্নয়নের জন্য অর্থ নিয়ে আসছি কিন্তু মেয়রের সঙ্গে সমন্বয় ছাড়া উন্নয়ন প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হবে। এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে একসঙ্গে আছি। কিন্তু হত্যা মামলায় সুবিধা পাওয়ার সুযোগ নেই।নিহত জেম আমার রক্তের কেউ না। তার ভাই-ভাতিজা আছে বাপ-মা আছে। তবে ওই ছেলেটা (জেম) আওয়ামী লীগের নিবেদিত কর্মী ছিল। এই হত্যা মামলা কার স্বার্থে বা কার ইন্ধনে এক বছর পর সিআইডিতে গেল।